স্মৃতির পাতা থেকে

লিখেছেন লিখেছেন জিহর ১৩ জুন, ২০১৩, ০৬:৩১:১৮ সন্ধ্যা

প্রিয় তারেক.......

তোমার কাছে বহুদিন ধরে কিছু লিখতে চাই। কিন্তু লেখা হয়না। অবশ্য নতুন কিছু নয়, পুরোনো কিছু স্মৃতি । যা আমার হৃদয়পটে ভেসে বেড়ায় এখনো। হুবহু সেই দিন গুলোর মত করেই। তোমার সাথে কত কথাই না হতো। সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না অনেক কথাই। কিন্তু হঠাৎ একদিন সব থেমে গেল। আমরা এক প্লেটে ভাত খেয়েছি কত বার। তুমি খুব সুন্দর করে আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে ভাত মেখে খেতে। এটা দেখতে আমার খুব ভাল লাগত। ওভাবে এখনো কি ভাত মেখে খেতে পার? তোমার হাতের লেখাটাও ছিল চমৎকার। আসলে তোমার হাতের লেখা দেখেই তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বের সুত্রপাত হয়েছিল। আগের মত করে কি এখনো লিখতে পার? তোমার আঙুলটাতো মধ্যগিরার একটু উপর থেকে কাটা হয়েছে।

সেদিন অর্থাৎ ২৬শে মে ২০১১ বৃহস্পতি বার তোমায় ব্যথার যন্ত্রণায় খুব কাতর দেখেছিলাম। এরপরেও অনেক দিন পর্যন্ত একটু ছোঁয়া লাগলেই কাতরে উঠতে। হাতের ব্যথাটা আশাকরি এখন আগের মত নেই। দোয়া করি এমন কষ্ট যেন তোমার জীবনে আর না আসে।

আচ্ছা সেদিন কী হয়েছিল ? ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। পরক্ষনে যখন জানতে পারলাম যে, তোমার ডান হাতের শাহাদাত আঙুলটি প্রায় ছিড়ে গেছে, তখন নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। নির্বাক ছুটে গেলাম ছাদে। মাদ্রাসার খেদমত করতে গিয়ে যেখানে নাইলনের রশিতে প্যাচ লেগেছিল তোমার হাতে। সেখানে তোমার লাল তাজা রক্ত দেখে আমি শিউরে উঠলাম। এর আগে কোন মানুষের গায়ের এত রক্ত দেখিনি এক সাথে। দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে তোমাকে পেলাম না। কে যেন বললো আল-আশরাফকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুব দ্রুত ছুটে গেলাম সেখানে। ফলাফল শুন্য। ফোন করে জানতে পারলাম, অবস্থার গুরুতরতার কারনে তোমাকে পঙ্গুহাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনটা কেঁপে উঠল। কী হতে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। প্রত্যক্ষদর্শী বন্ধু মাহদী ও জাহিদ ভাই জানালেন, তোমার হাতের শাহাদাত আঙ্গুলের নিচের দিকে প্রায় পুরো চামড়াই সেই রশিতে কেটে গেছে। ওখান থেকে নাকি রক্ত মাখা হাড়ও দেখা যাচ্ছিল। হয়ত শিরাগুলি কেটে গেছে। তা না হলে এতো রক্ত বের হবে কেন। সেদিন দুপুরে আমার কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি।

আরো অনেক বন্ধুও খাবার খায়নি, সবাই বিষন্নমনে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালা কে ডাকতে লাগলাম। সবার একই প্রার্থনা, হায় আল্লাহ ! যেন কোন দুঃসংবাদ শুনতে না হয়। কিন্তু ভাগ্যের লিখন ফেরায় সাধ্য কার। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। আশা আর পুরণ হলো না। বিকাল পাঁচটার দিকে ফোনালাপ হলো মাসুম ভাইয়ের সাথে। তিনি এবং শাকিল ভাই তোমার সাথে হাসপাতালে ছিলেন।

এবার শুনতে হলো ভিন্ন সংবাদ। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। দুঃখে কষ্টে সবার বুকের স্পন্দন থেমে গেল। কারো সাথে কেউ কথা বলছিল না দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত। তোমার ঐ আঙুলটা নাকি কেটে ফেলা হবে। যা পার্থিব জীবনে মানুষের অপরিহার্য সঙ্গি। স্রষ্টার নিঁখুত সৃষ্টির অনুপম সৌন্দর্য। কিন্তু সবাই নিরুপায়। বিজ্ঞ চিকিৎসক জানালেন, এই আঙুল কাটা না হলে হাতে পচন ধরার আশংকা আছে। তাই ডাক্তার তোমার অবিভাবকদের সাথে কথা বলে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এবং তাই হল। আর তুমি হয়ে রইলে আমাদের মাদ্রাসার একম্ত্র সাক্ষী। যে মৃত্য পর্যন্ত এই সাক্ষ্য বহন করে চলবে।

কিন্তু সময়ের স্রোতে সবকিছু হারিয়ে যায়। চোখের আড়াল হলে মানুষ সব কিছু ভুলে যায়। তাই ধীরে ধীরে অনেকেই যেন তোমার কথা ভুলে গিয়েছে। সবকিছু যেন অতিতে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। আসলে পৃথিবীর জীবন এমনি। জীবনের নতুন নতুন প্রকাষ্টে মানুষ অতীতকে ভুলে যায়। তবে জীবনের শত প্রবাহের মাঝেও কিছু কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে বারবার। মানুষ তা কখনো ভুলতে পারে না। তোমার সাথে সঙ্গ জীবনের আনন্দময় মুহুর্ত গুলো কখনো ভুলতে পারব না। তোমার নির্মল হাসি, সাবলীল কথাবার্তা এবং তোমার সেদিনের তাজা রক্ত আর বিমর্ষ চেহারা, স্মৃতির আয়না থেকে এসব মুছবে না কখনো।

তবে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তোমার কষ্ট লিখা হয়ে গেছে। তোমার কোরবানি তাঁর দরবারে গৃহিত হয়েছে। এর বিনিময়ে যেন তুমি চিরসুখের জান্নাত পাও, আর তখনো যেন আমরা তোমার সে সুখের সঙ্গি থাকি। এই কামনায়......

জহির বিন এ হান্নান

মাদ্রাসাতুল ফাতাহ, উত্তরা,ঢাকা

বিষয়: বিবিধ

২৩০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File